ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪

ইলিশসহ মাছের পাঁচ প্রজনন ক্ষেত্র সংকটে

আবু তাহের, কক্সবাজার অফিস :::

চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সমুদ্রের উপকূল মারাত্মক দূষণের শিকার। ফলে নদীর মোহনায়  মাছের পাঁচ প্রজনন ক্ষেত্র এখন মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, প্রতিবছর প্রজনন মৌসুমে ইলিশ ধরা বন্ধ রাখার ফলে উৎপাদনের পরিমাণ কিছুটা বাড়লেও বৃহত্তর চট্টগ্রামের এসব প্রজনন ক্ষেত্র নষ্ট হওয়ায় এখানে ইলিশের বংশ বৃদ্ধি আশানুরূপ হচ্ছে না।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছে যে, কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামের ভাটিয়ারী পর্যন্ত প্রায় ২০০ কিলোমিটার উপকূলজুড়ে সমুদ্রের পানিতে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। নদীর মোহনায় এই দূষণের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। এ অবস্থায় কর্ণফুলী, শঙ্খ, মাতামুহুরী, বাঁকখালী এবং রেজু খালের মোহনায় মাছের প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস হতে চলেছে। জেলেরা জানিয়েছেন, প্রজনন মৌসুমে এই ৫ নদীর মোহনায় ইলিশের বিচরণ আগে বেশি পরিলক্ষিত হলেও এখন আগের মতো এদের তেমন দেখা যায় না।

কক্সবাজারে মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুর রহমান জানিয়েছেন, ডিম ছাড়ার সময় হলে নদ-নদীর মোহনায় যেখানে মিষ্টি পানির ধারা প্রবাহিত হয় সেখানে দল বেঁধে ইলিশ চলে আসে। কর্ণফুলী, শঙ্খ, মাতামুহুরী, বাঁকখালী এবং রেজু খালের মিষ্টি পানির মোহনা হচ্ছে মাছের প্রজনন ক্ষেত্র। তিনি জানান, এই ৫ নদীর মোহনায় এখন দূষণের মাত্রা অনেক বেশি। কল-কারখানার বর্জ্য ও ক্ষতিকর রাসায়নিক, নৌকা মেরামতের ডকইয়ার্ড থেকে ফেলা ময়লা-আবর্জনা ও জ্বালানি তেল এবং সমুদ্রগামী জাহাজ থেকে ফেলা ক্ষতিকর বর্জ্যের কারণে সমুদ্র উপকূলে দূষণ অব্যাহত রয়েছে। ফলে ইলিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছের প্রজনন ক্ষেত্র ক্রমান্বয়ে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।

ড. শফিকুর রহমান বলেন, সমুদ্র উপকূলজুড়ে তেল জাতীয় দূষণের মাত্রা এখন সবচেয়ে বেশি। দূষণের ফলে ইলিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক মাছের প্রজনন ক্ষেত্রগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রজনন ক্ষেত্র নষ্ট হওয়ায় বঙ্গোপসাগরে ৪৭৫ প্রজাতির মধ্যে বহু প্রজাতির মাছ এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এ বিষয়ে ব্যাপক জরিপ চালানোর প্রয়োজন রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

জেলার পরিবেশ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সমুদ্র উপকূলজুড়ে তেলজাতীয় পদার্থের কারণে দূষণের মাত্রা সবচেয়ে বেশি। এখানে প্রতি লিটার পানিতে ১০০ থেকে ১৩০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত তেল জাতীয় পদার্থের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। কর্ণফুলী, সাঙ্গু, মাতামুহুরী ও বাঁকখালী নদীর মোহনায় দূষণের মাত্রা আরও বেশি। সূত্র জানায়, উপকূলজুড়ে সারা বছর ধরে দূষণের মাত্রা বেশি থাকে। শীতকালে তা ভয়াবহ পর্যায়ে চলে যায়। কর্মকর্তা আরও জানান, প্রতি লিটার পানিতে ২০ মিলিগ্রাম তেল জাতীয় পদার্থের উপস্থিতি থাকলে তা সহনীয় বলে গণ্য করা হয়। এর ওপরে গেলেই দূষণের পর্যায়ে বিবেচনা করা হয়।

দেশের প্রধান ইলিশ গবেষক এবং মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট পরিচালিত নদী কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আনিছুর রহমান জানান, মাছ ধরার যান্ত্রিক নৌকা এবং মালবাহী জাহাজ থেকে নিক্ষিপ্ত বর্জ্যের কারণে সমুদ্রের দূষণ হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। সাগরে ৩০ হাজারের বেশি মাছ ধরার ট্রলার রয়েছে। এদের মাধ্যমে দূষণ হচ্ছে উল্লেখ্যযোগ্য হারে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারকারী জাহাজগুলো কর্ণফুলী থেকে কুতুবদিয়া উপকূল পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে প্রতিনিয়ত বর্জ্য নিক্ষেপ করছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন নদী মোহনায় রয়েছে অসংখ্য ছোট-বড় ডকইয়ার্ড। এখানে মাছ ধরার নৌকা ও ইঞ্জিন সার্ভিসিং করে সেসব বর্জ্য ফেলা হচ্ছে সমুদ্রে। ফলে ক্রমাগত মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রগুলো দূষিত হয়ে পড়ছে

পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার অফিসের সহকারী পরিচালক সর্দার শরিফুল ইসলাম সমুদ্র দূষণের কথা স্বীকার করে বলেন, এ বিষয়ে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলকে অবহিত করা হচ্ছে। তিনি জানান, বাঁকখালীসহ কয়েকটি নদীর পানি মারাত্মক দূষিত হয়ে পড়ছে। এখানে অক্সিজেনের পরিমাণ প্রতি লিটার পানিতে স্থানভেদে ৩ মিলিগ্রামের নিচে নেমে যাচ্ছে, যা মৎস্য প্রজননের জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমকাল

পাঠকের মতামত: